মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকার অনুমোদিত অনলাইন গণমাধ্যম
BD.GOV.REG.NO-88

মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকার অনুমোদিত অনলাইন গণমাধ্যম
BD.GOV.REG.NO-88

আপনি পড়ছেন : বিশ্ব

করোনাভাইরাসের ‘অ্যাকিলিস হিলের’ খোঁজে বিজ্ঞানীরা


DhakaReport24.com || 2021-02-24 20:38:30
করোনাভাইরাসের ‘অ্যাকিলিস হিলের’ খোঁজে বিজ্ঞানীরা


করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই মহামারীর মধ্যে সুস্থভাবে বেঁচে থাকছেন কিছু মানুষ। করোনা যেন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না। কেন করোনাভাইরাস তাদের সংক্রমিত করতে পারছে না, তা অনুসন্ধানে নেমেছেন বিজ্ঞানীরা। আর এজন্য সংগ্রহ করা হচ্ছে এসব মানুষদের রক্তসহ জিনের নানা তথ্য। লক্ষ্য একটাই, এই ভয়ঙ্কর মহামারীর ‘অ্যাকিলিস হিল’ খুঁজে বের করা।

উল্লেখ্য, গ্রিক পৌরানিক কাহিনীতে ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী অ্যাকিলিসের অতিঅল্প বয়সে মৃত্যু এড়াতে তার মা থেটিস তাকে অলৌকিক স্টাইক্স নদীতে চুবিয়ে নেন।  কিন্তু পা ধরে উপুর করে চুবানোর কারণে শুকনো রয়ে যায় অ্যাকিলিসের টাকনু।  অ্যাকিলিস এরপর বড় হন, বহু যুদ্ধ জয় করেন। কিন্তু হোমারের ইলিয়াডে অ্যাকিলিসের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেন হেক্টর। বলা হয়, তিনি টাকনু, আঙ্গুল বা পায়ের গোছায় আঘাত পেয়ে মারা যাবেন।  গ্রিক উপাখ্যানের বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধে প্যারিসের ছোঁড়া তীরে নিহত হন অ্যাকিলিস। সেই থেকে কোনো সুরক্ষিত প্রাণি বা বস্তুর দুর্বল অংশ বুঝাতে ‘অ্যাকিলিস হিল’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়।

মহামারী থেকে বেঁচে যাওয়ার ইতিহাস পুরনো।  এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলা যেতে পারে। ১৯৭৮ সালে সমকামী তরুণ স্টিফেন ক্রোন দেখলেন, অজানা এক রোগে মারা যাচ্ছেন তার আশপাশের সব বন্ধুরা। একসময় ওই রোগে আক্রান্ত হলেন তার সঙ্গী জেরি গ্রিনও। তখন স্টিফেন ধরেই নিলেন যে, রোগটির পরের শিকার তিনি।কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন। এর পরের কয়েকবছরে রোগটিতে স্টিফেন হারান আরও অসংখ্য পরিচিত মানুষকে। পরে জানা যায়, রোগটির নাম এইডস।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে নিউইয়র্কের অ্যারন ডায়মন্ড এইডস রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ইমিউনোলোজিস্ট বিল প্যাক্সটন একটি গবেষণার কাজে সমকামী পুরুষ খুঁজছিলেন যারা এইডসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত। তিনি এর কারণ অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে স্টিফেনের রক্তের শ্বেতকণিকার সঙ্গে একই টেস্টটিউবে রাখেন এইডসের ভাইরাসকে। দেখা যায়, স্টিফেনের শ্বেত রক্তকণিকাকে আক্রান্ত করতে পারছে না এইচআইভি।

জানা যায়, স্টিফেনের শরীরে বিশেষ ধরনের জিনগত পরিবর্তনের (মিউটেশন) কারণে এইচআইভি তার রক্তকণিকাকে আক্রান্ত করতে পারছে না।আর এই ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে খুব বেশি হলে পৃথিবীর ১ শতাংশ মানুষের মধ্যে। জিনগত পরিবর্তনের এই ধারা ব্যবহার করে দীর্ঘ গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন এইডস রোগের ওষুধ।

২০১৩ সালে স্টিফেন মারা যান, কিন্তু তার এই গল্প জুড়ে যায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে। গত দুই দশকে এই গল্প চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন গবেষণায় দারুণ অবদান রেখেছে। যে কোনো রোগ নিয়ে গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা এমন মানুষকে খুঁজে বের করেন যারা স্টিফেনের মতো রোগ প্রতিরোধী শক্তি নিজেদের ভেতর ধারণ করেন। আর তাদের এই প্রতিরোধী ক্ষমতা থেকেই আবিষ্কার হয় রোগটি চিকিৎসার নতুন পদ্ধতি।

নিউইয়র্কের আইকান স্কুল অব মেডিসিনের জিনতত্ত্ববিদ জেসন বোব দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের মানুষদের নিয়ে গবেষণা করছেন যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন না। ফলে যখন বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারী শুরু হলো, তখন জেসন বোব দেখতে চাইলেন যে, এমন কোনো মানুষ আছে কিনা যাকে করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে পারে না।

তখন জেসন বোব এমন পরিবার খুঁজতে শুরু করলেন, যেখানে পরিবারের সবাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও কেউ একজন সংক্রমিত হননি। এমন কোনো পরিবারকে পাওয়া গেলে সুবিধা হয়, কারণ এতে ওই বিশেষ জিনের বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝা যায়। 

কভিড-১৯ রোগী ও তাদের পরিবার নিয়ে কাজ করে এমন কিছু ফেসবুক গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন জেসন। গতবছরের জুন থেকে কাজ শুরু করেন তিনি, তৈরি করেন একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে উপসর্গবিহীন করোনা সংক্রমিত যে কেউ তার তথ্য যোগ করতে পারেন।

একমাস পরে জেসন বোব তার পাওয়া তথ্যগুলো সাজাতে শুরু করেন। কভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধী লক্ষণগুলো মিলিয়ে তিনি দেখতে চান, যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন না, তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলো এক কিনা। যদি একই হয় তাহলে, এই বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিভাইরাস তৈরি করা সম্ভব। 

এরই মধ্যে কিছু সূত্র পাওয়া গেছে। গবেষকরা দেখেছেন, টাইপ ‘ও’ এবং আরএইচ ফ্যাক্টর নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপের মানুষের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে গবেষকদের মতে, যাদের রক্তে এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে তারা প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে পারেন। তবে এর সঠিক কারণটি এখনো অজানা।

অন্যদিকে ইউনিভার্সিটি অব সাওপাওলোর হিউম্যান জিনোম রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মায়ানা জাৎজ ১০০ দম্পতিকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও অন্যজন হননি। তিনিও এই দম্পতিদের ওপর গবেষণা করে দেখতে চান যে, কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে সঙ্গী আক্রান্ত হলেও তারা হননি। 


শুধু তাই নয়, শতবর্ষী ১২ জনের জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়েও কাজ করছেন মায়ানা। যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও উপসর্গ ছিল খুব মৃদু। এদের একজন ১১৪ বছরের নারী, যিনি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পরও সুস্থ হয়ে গেছেন। সম্ভবত তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী মানুষ যিনি ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন।যেখানে বয়স্করাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বয়স্কদের মৃত্যুহারই সবচেয়ে বেশি। সেখানে কীভাবে বা কোন প্রতিরোধী শক্তির কারণে তিনি বেঁচে ফিরেছেন তা গবেষণার বিষয় বৈকি।

রকফেলার ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বলছেন, হার্পাস থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা, সব ভাইরাস রোগের ক্ষেত্রেই দেখা যায় কিছু মানুষ ঘনঘন আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার কিছু মানুষ আক্রান্ত হলেও কোনো উপসর্গ দেখা যায় না।এর মূল কারণ হলো, জিন মিউটেশন, যা কাউকে কাউকে ওই বিশেষ প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে সংবেদনশীল করে তোলে। 

কভিড-১৯ মহামারী শুরুর সময় এটা পরিষ্কার ছিল যে, বয়স্ক ব্যক্তি কিংবা যারা আগে থেকেই জটিল রোগে ভুগছেন তারা দ্রুত আক্রান্ত হবেন। কিন্তু রকফেলার ইউনিভার্সিটির গবেষকদের আগ্রহ ছিল ভিন্নধর্মী ঘটনাগুলোর প্রতি। যেমন, আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ ৩০ বছর বয়সী কেউ যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভেন্টিলেশনে চলে যান। সেই কারণ অনুসন্ধানে নামেন রকফেলারের গবেষকরা। একাজে তাদের সঙ্গী হয় বেলজিয়াম থেকে তাইওয়ানের বেশকিছু মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৬০ সালে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে, মানুষের শরীরের কোষগুলোতে একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি থাকে। যা তাকে কোনো ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক ও প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করতে সহায়তা করে। বিজ্ঞানীরা বলেন, যখন কোনো ভাইরাস একটি কোষে প্রবেশ করে তখন সেই কোষটি তার চারপাশে টাইপ ওয়ান ইন্টারফেরন নামে প্রোটিন তৈরি করে। এর মাধ্যমে অন্য কোষগুলিও আক্রমণের খবর পেয়ে যায় এবং ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে সবরকমের পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। তবে যদি, সংক্রমণটি মারাত্মক আকারের হয় তাহলে কোষগুলো বেশি পরিমানে টাইপ ওয়ান ইন্টারফেরন উৎপন্ন করে রক্তপ্রবাহে মিশিয়ে দেয়। যাতে করে পুরো শরীর ভাইরাস সংক্রমণের খবর পেয়ে যায়।

তবে কখনো কখনো এই ঘটনা ঘটে না। মানে কোষগুলো সঠিকভাবে সতর্কবার্তা পাঠাতে পারে না। তখনই বাঁধে গোল। 

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে হওয়া এক গবেষণায় ৯৮৭ জন কভিড-১৯ রোগীর তথ্য থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের নিউমোনিয়া হয়েছিল। এই রোগীরা হয় ৫০-এর কম বয়সী বা ৫০ বছরের বেশি বয়সী। যাদের অন্য কোনো রোগও ছিল না। এদের ৩ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে বড় ধরনের জিন মিউটেশন হয়েছে যার ফলে তাদের শরীরে টাইপ ওয়ান ইন্টারফেরন কাজ করেনি।

আর ১০ শতাংশের শরীরে অটোঅ্যান্টিবডি নামে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। যেগুলো কোষের উৎপন্ন করা ইন্টারফেরন প্রোটিনকে রক্তে প্রবাহিত হতে বাধা দেয়। ফলে বাকি শরীর আর ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পায় না। ইমোরি ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা বলছে, এই অটোঅ্যান্টিবডি কভিড-১৯-এ আক্রান্ত শরীরকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে বাধা দেয়। যার ফলে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থসবল মানুষও করোনাভাইরাসের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন।

রকফেলারের বিজ্ঞানীরা এখন মানুষের মধ্যে থাকা এই অটোঅ্যান্টিবডিকে খুঁজছেন, যাতে করে বোঝা যায় যে, কারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। সে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন ব্লাডব্যাংকগুলোতেও খোঁজ করা হচ্ছে যেন, অটোঅ্যান্টিবডি আছে এমন মানুষদের আলাদা করা যায়। 

সবমিলিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন এমন জিনগত বৈশিষ্ট্যের খোঁজ করছেন যার কারণে শুধু করোনাভাইরাস নয়, যে কোনো ধরনের ভাইরাস প্রতিরোধী ক্ষমতা কোনো কোনো মানুষের শরীরেই মজুদ থাকে। তাদের আশা, জিনের এই ধরনের ক্ষমতার বিষয়টি খোলাসা হলে এসব সংক্রামক ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইটা আরো সহজ হবে।

সূত্র: বিবিসি